বাংলাদেশ প্রাকৃতিকদুর্যোগ মোকাবেলায়বেশ অভিজ্ঞ হলেওকরোনার মতো বৈশ্বিকমহামারী মোকাবেলারঅভিজ্ঞতা তেমন নেই।কারণ নিকট অতীতেবাংলাদেশ এ ধরনেরভয়াবহ মহামারীরমুখোমুখি হয়নি। মার্স,সার্স ও ইবোলার মতোমহামারীর আঁচবাংলাদেশে তেমন লাগেনি। তাই বাংলাদেশ করোনার মতো মানুষবাহিতমহামারীর মুখোমুখি গুটি বসন্ত ও কলেরার পর আর হয়নি। ফলে এ ধরনেরমহামারী মোকাবেলায় ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক। শুধু বাংলাদেশ নয়,যুক্তরাষ্ট্রসহ আরো কিছু দেশও করোনা মোকাবেলায় শুরু থেকেই ভুল পথেহেঁটেছে বলে ধারণা করা হয়। এ ধরনের বৈশ্বিক মহামারী মোকাবেলায়সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি না থাকায় বিশ্ব ট্রায়াল অ্যান্ড এরর মেথডেরপথে হাঁটছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শুরু থেকে এ মহামারী মোকাবেলায় আমরা কতগুলোভুল করে ফেলেছি। যেমন বিদেশফেরত, বিশেষ করে ইতালিফেরতপ্রবাসীদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের বদলে হোম কোয়ারেন্টিনে পাঠানো,করোনা শনাক্তের পরীক্ষার সুবিধা প্রথম দিকে বিকেন্দ্রীকরণ না করে শুধুআইইডিসিআরের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে সব সম্ভাব্য কভিড-১৯ রোগীকেঢাকায় আসতে বাধ্য করা, গণপরিবহন বন্ধের আগে সরকারি ছুটি ঘোষণাকরা, লকডাউন চলাকালে কোনো বিশেষ পরিবহন ব্যবস্থা ছাড়া পোশাকশ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে আনা এবং ফেরত পাঠানো, নারায়ণগঞ্জের মতোচিহ্নিত হটস্পটেও কার্যকরীভাবে লকডাউন করতে না পারা এবং সর্বশেষঅর্থনীতি অবরুদ্ধ থাকা সত্ত্বেও দোকানপাট ও শপিংমল খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত।
উল্লেখ্য, হোম কোয়ারেন্টিন পশ্চিমা বিশ্বের কম ঘনবসতিপূর্ণ এবংবসবাসের জন্য মাথাপিছু বেশি স্পেস ও বেশি কক্ষবিশিষ্ট দেশে মেনে চলাসম্ভব হলেও আমাদের মতো মাথাপিছু কম স্পেস ও কম কক্ষবিশিষ্ট দেশেতা যে মেনে চলা সম্ভব নয়, এটি একেবারেই ভাবা হয়নি। আর দেশে ফেরতআসা প্রবাসীদের জন্য তা যে কোনোভাবেই সম্ভব নয়, তাও ভাবা হয়নি।দীর্ঘদিন পর কোনো প্রবাসী দেশে ফিরলে পরিবার-পরিজনের ঘনিষ্ঠসংস্পর্শে আসা আমাদের সংস্কৃতিরই অংশ। দীর্ঘদিনের রীতিনীতি ও সংস্কৃতিকিন্তু রাতারাতি পরিবর্তন করা যায় না। তাই দেশে আসা প্রবাসীদের জন্যহোম কোয়ারেন্টিন মেনে চলা যে সম্ভব নয়, তা না ভাবা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।এক্ষেত্রে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে কোয়ারেন্টিনপদ্ধতির প্রায়োগিক দিক বিবেচনা না করেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে ধারণাকরা যায়।
এ সবগুলোই আমাদের এ ধরনের মহামারী মোকাবেলার অভিজ্ঞতা নাথাকারই ফল। এখন আর ভুলের পুনরাবৃত্তি করার সুযোগ নেই। আবারো ভুলকরলে খেসারতের অংকটা কিন্তু অনেক বড় হবে।
গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পর দুই মাসের বেশিঅতিবাহিত হয়েছে। ওই সময়ে টেস্টের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগীশনাক্তের সংখ্যাও আনুপাতিক হারে বেড়েছে। তবে যাদের টেস্ট করা দরকার,তাদের সবাইকে টেস্ট করা সম্ভব হচ্ছে না। আর তাদের সংখ্যাও আমাদেরজানা নেই। ফলে প্রকৃত রোগীর সংখ্যা কত, তা আমরা জানি না। তাইআগামী দিনগুলোয় করোনার ভয়াবহতা কী রূপ হবে তার প্রকৃত চিত্র পাওয়াসম্ভব নয়। কেননা করোনা রোগী কত হতে পারে তা নিয়ে যে প্রজেকশন করাহয়েছে, এটি শুধু শনাক্ত রোগীর সংখ্যার ভিত্তিতে করা।
যে-সংখ্যক মানুষ বর্তমানে টেস্টের আওতায় এসেছে আর যাদের টেস্টকরার প্রয়োজন আছে কিন্তু টেস্ট করা সম্ভব হয়নি বা টেস্ট করতে আসেনি,তা বিবেচনা করলে প্রকৃত রোগীর সংখ্যা প্রজেক্টেড সংখ্যার তুলনায় অনেকবেশি হতে পারে। তাই এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় একদিকে যেমন বেশিপরিমাণ টেস্ট করার সম্ভাব্য সব সুযোগ কাজে লাগাতে হবে, অন্যদিকে স্বাস্থ্যখাতকে অনিশ্চিত পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত রাখতে হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশে অপরচুনিস্টিক পদ্ধতিতে অর্থাৎ যারা প্রয়োজন মনেকরছে এবং সুযোগ পাচ্ছে, শুধু তাদের টেস্ট করা হচ্ছে। কমিউনিটি পর্যায়থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ব্যাপকভাবে টেস্ট করা ছাড়া করোনা সংক্রমণেরপ্রকৃত অবস্থা জানা সম্ভব না। এজন্য উপজেলা পর্যায়ে এবং প্রয়োজনে ইউনিয়ন বা মহল্লা পর্যায়ে নমুনা সংগ্রহের বুথ চালু করা যেতে পারে।উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণএবং যথোপযুক্ত ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামাদি প্রদানের মাধ্যমে তাদের নমুনাসংগ্রহের কাজে নিয়োজিত করা যেতে পারে। এসব নমুনা পরীক্ষার জন্য সবজেলায় টেস্টের ব্যবস্থা করতে হবে।
সাধারণত কোনো দুর্যোগ বা মহামারীর ভয়াবহতা কী রকম হতে পারে, তারপ্রকৃত অনুমান যে করা সম্ভব নয়, তা আমরা বুলবুলসহ কয়েকটা ঘূর্ণিঝড়থেকে দেখেছি। করোনার ক্ষেত্রেও এটা সত্য। তাই মহামারী বা দুর্যোগমোকাবেলায় দরকার হোক বা না হোক, প্রস্তুতিটা কঠোর হওয়া প্রয়োজন।
প্রজেকশন অনুযায়ী মে মাসের শেষে কভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা যদি ৫০হাজারে দাঁড়ায় তাহলে বর্তমান সুস্থতার হার বিদ্যমান থাকলে একসঙ্গে প্রায়৪০ হাজার রোগীর চিকিৎসার দরকার হবে। কিন্তু রোগীর সংখ্যা এক লাখেদাঁড়ালে একসঙ্গে প্রায় ৮০ হাজার মানুষের চিকিৎসার দরকার হবে। আর যদিরোগীর সংখ্যা দুই লাখে দাঁড়ায় তাহলে একসঙ্গে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজারজনের চিকিৎসার দরকার হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রায় ৮০ শতাংশ করোনারোগীর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন হয় না। বাড়িতে বা অন্য কোথাওআইসোলেশন থেকে চিকিৎসা নিলেই সুস্থ হয়ে ওঠে। বাকি ২০ শতাংশরোগীর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন হয়। সে হিসাবে মে মাস শেষেপ্রায় আট হাজার বা ১৬ হাজার বা ৩২ হাজার বা তার বেশি করোনা রোগীরএকসঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। আবার যারাহাসপাতালে ভর্তি হবে, তাদের প্রায় ৫-১০ শতাংশের ভেন্টিলেশন বাআইসিইউ সেবার প্রয়োজন হবে। এ হিসাবে ন্যূনতম ৪০০ বা ৮০০ বা ১হাজার ৬০০ রোগীর একসঙ্গে ভেন্টিলেশন বা আইসিইউ সেবার প্রয়োজনহতে পারে। তাই প্রয়োজন হোক আর না হোক, এ-সংখ্যক করোনা রোগীব্যবস্থাপনার জন্য স্বাস্থ্য খাতকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, কিশোরগঞ্জের মতোউচ্চসংক্রমণশীল এলাকায় কমিউনিটি সংক্রমণ শুরু হয়েছে। জনগণএকদিকে যেমন লকডাউন মানছে না, অন্যদিকে দোকানপাট ও শপিংমলখুলে দেয়ায় কমিউনিটি সংক্রমণ আরো অনেক এলাকায় ছড়িয়ে পড়তেপারে। উল্লেখ্য, প্রায় দেড় মাস ধরে অর্থনীতি টানা অবরুদ্ধ থাকার ফলেএকদিকে যেমন অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরস্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের হিসাবমতে দৈনিক অনুমিত ক্ষতির পরিমাণপ্রায় ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা), অন্যদিকে কার্যকরীভাবে লকডাউন নামেনে চলার প্রবণতাও বেড়েছে। আমরা যদি শুরু থেকে অধিক হারে টেস্টকরে দ্রুত হটস্পটগুলো চিহ্নিত করতে পারতাম এবং হটস্পটভিত্তিক ছোটছোট এলাকায় কার্যকরীভাবে লকডাউন করে অন্যত্র অর্থনীতি অবমুক্ত করেদিতে পারতাম তাহলে সংক্রমণ ও অর্থনৈতিক ক্ষতি উভয়ই কমিয়ে আনাসম্ভব হতো। কিন্তু আমরা সেই সুযোগ গ্রহণ করতে পারিনি। তাই বর্তমানঅবস্থায় স্বাস্থ্যসেবার পরিসর বাড়ানো ছাড়া আমাদের সামনে আর তেমনকোনো পথ খোলা নেই।
আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে মেডিকেলবিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সরকারি খাতের একটা শক্তিশালী নেটওয়ার্ক থাকলেওআইসিইউসহ শয্যা সংখ্যার ভিত্তিতে বেসরকারি খাতের আকার অনেক বড়।উল্লেখ্য, দেশে হাসপাতালের মোট শয্যা সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার, যারমধ্যে মাত্র ৩৬ শতাংশ সরকারি হাসপাতালে এবং বাকি ৬৪ শতাংশবেসরকারি হাসপাতালে। দেশের আইসিইউ বেডের বেশির ভাগ অংশওবেসরকারি খাতে। প্রতি বছর মাত্র ১৫ শতাংশ রোগী সরকারি হাসপাতাল ওস্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করে। বাকি ৮৫ শতাংশের ২৫ শতাংশপ্রাতিষ্ঠানিক বেসরকারি খাত থেকে এবং ৬০ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিকবেসরকারি খাত থেকে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করে। তাই বলা চলে বাংলাদেশেরস্বাস্থ্য ব্যবস্থা অনেকাংশেই বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তুকরোনার মতো ভয়াবহ মহামারী মোকাবেলায় বেসরকারি খাতের সক্রিয়অংশগ্রহণ এখন পর্যন্ত চোখে পড়ার মতো নয়।
করোনা মোকাবেলায় বাড়তি প্রস্তুতি হিসেবে সরকার ভেন্টিলেশন সুবিধাসম্মিলিত বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারসহ দুটো হাসপাতাল প্রস্তুত করেছে।সরকার এরইি মধ্যে দুই হাজার ডাক্তার এবং পাঁচ হাজার নার্স নিয়োগেরপ্রক্রিয়াও শেষ করেছে। যেহেতু চিকিৎসক এবং অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের ১৪ দিনপরপর কোয়ারেন্টিনে যেতে হচ্ছে এবং এখন পর্যন্ত চিকিৎসক এবং অন্যান্যস্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে প্রায় এক হাজার জন কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছেন,তাই এই বাড়তি জনবল নিয়োগ খুব সময়োচিত পদক্ষেপ। কিন্তু ভেন্টিলেশনও আইসিইউসহ কভিড-১৯ চিকিৎসায় যে ধরনের দক্ষতা দরকার, তা তাদেরহয়তো নেই। আবার ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে এ দক্ষতা অর্জন করাওসম্ভব নয়। অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতালে ভেন্টিলেশন ও আইসিইউ সেবাপ্রদানের জন্য যথেষ্ট দক্ষ জনশক্তি থাকার কথা।
তাই কভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসা পরিসর দ্রুত বাড়ানোর জন্য প্রতিএলাকায় জুতসই কিছু বেসরকারি হাসপাতালকে আপাতত তিন-চার মাসেরজন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় আনা যেতে পারে। এরই মধ্যে নতুন তিনটিসহছয়টি বেসরকারি হাসপাতালকে এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা হয়েছে। আরোহাসপাতালকে যুক্ত করে এসব হাসপাতালের পরিচালনার দায়িত্ব আর্মিমেডিকেল কোরের ওপর ছেড়ে দেয়া যেতে পারে।
তাছাড়া করোনার কার্যকরী ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধক উদ্ভাবন না হওয়াপর্যন্ত এবং বাংলাদেশে এর ব্যাপক ব্যবহার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত রাস্তাঘাট,বাজার, কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব পাবলিক প্লেসে সবাইকেবাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক ব্যবহারসহ করোনাসংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলারওপর জোর দিতে হবে।
এসব ব্যবস্থা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে পারলে জুনের শুরুতে ঢাকা মহানগরী,নারায়ণগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদীর মতো অতিসংক্রমিত এলাকাএবং হটস্পটভিত্তিক ছোট ছোট এলাকায় লকডাউন কর্যকরীভাবে বাস্তবায়নকরে অন্যত্র অর্থনীতি উন্মুক্ত করে দেয়া যেতে পারে।
ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ: অধ্যাপক
0 comments: